একদিন পরেই রাজশাহী কলেজের প্রিন্সিপাল ।কলেজ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিবেন।

0
160

 পিকনিক স্পটে, মার্চের অগ্নিবৎ রোদ্রে সুস্থির দাঁড়িয়ে আছেন প্রিন্সিপাল। একঝাঁক শিক্ষার্থী প্রস্তুত ভঙ্গিতে অদৃশ্য লাইন লাগিয়েছে উনার সঙ্গে ছবি তোলার জন্য। ঝাঁকের মধ্য থেকে এক-এক করে আসছে; উনার সাথে ছবি তুলছে; চলে যাচ্ছে। শুধু অবস্থানের পরিবর্তন হচ্ছে না প্রিন্সিপালের। তিনি হাসি-হাসি মুখ করে সেই ছবিগুলো শোভাবর্ধনে সহযোগিতা করছেন। শিক্ষার্থী তো অনেক; আর কার না মন চায় কিংবদন্তীর সাথে একটা ফ্রেমবন্দী স্মৃতি রেখে দেওয়ার? স্বাভাবিকভাবে ফটোসেশান পর্ব দীর্ঘ হয়ে গেছে ঘড়ির মিনিটের কাঁটা পূর্ণঘূর্ণন কোণ উৎপন্ন করা অবধি। আমি ছাঁয়ায় দাঁড়িয়ে নীমিলিত চোখে দেখছি—  একজন প্রিন্সিপালের প্রতিটা শিক্ষার্থীর ইচ্ছা পূরণের দ্ব্যর্থহীন চেষ্টা। তিঁনি অবলীলায় জিজ্ঞাসা করলেন— কেউ বাদ পড়েছো? বাদ পড়লে আসো, ছবি তুলি! 

[বৎসলতা]

এগারোটা বেজে দুই মিনিট। প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে আছেন চারতলার গেটের সামনে। গেটম্যান নয়নের মুখ থমথমে। সে জানে না কী হতে যাচ্ছে। দুই মিনিট পার হয়ে গেছে—  একজন শিক্ষক এখনও ক্লাসে আসেননি। তিন মিনিটের মাথায় ওই শিক্ষক মহোদয় সিঁড়ি ভেঙে চারতলার কাছাকাছি আসতেই প্রিন্সিপাল নিজ হাতে গেট লাগিয়ে দিলেন। শিক্ষককে ক্লাসে ঢুকতে দিলেন না। [সময়ানুবর্তিতা]

একদা হাঁটতে-হাঁটতে প্রিন্সিপাল দেখলেন— হাজী মোহাম্মদ মুহসীন ভবনের সামনে একটা কাগজ পড়ে আছে। ব্যাপারটা পরিষ্কারকের নজর এড়ালেও চক্ষুশূল হয়েছে প্রিন্সিপালের। তিঁনি নিজ হাতে কাগজটি তুলে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ফেলে দিলেন। 

[সৌন্দর্যবোধ]

পরীক্ষায় পাশ করতে না পেরে এক শিক্ষার্থী প্রমোশনের জন্য সহমত ভাই (নেতা) নিয়ে আসলো। প্রিন্সিপাল সেই নেতাকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন— তিঁনি র‍্যুলস্ এর বাইরে যাবেন না।

[ব্যক্তিত্ব সচেতনতা]

পর্যাপ্ত পরিমাণ এটেনডেন্স না থাকায় একবার (সম্ভবত এই কাজটা তিঁনি একাধিকবার করেছেন) তিঁনি শতাধিক শিক্ষার্থীকে পরীক্ষায় বসতে দেননি। 

[নিয়মানুবর্তিতা]

শারমিন নামের এক ‘হুইলচেয়ার মানবীর’ লেখাপড়ার সমস্ত ব্যয় বহন করছিল কলেজ কর্তৃপক্ষ। সে যখন স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়ে পরিবারের বোঝা হতে যাচ্ছিল; ঠিক তখনই কলেজের ‘কম্পিউটার অপারেটর’ পদে তাকে নিযুক্ত করে দেন প্রিন্সিপাল। 

[মানবতাবোধ]

অডিটোরিয়ামে বক্তৃতা দিচ্ছে এক জীর্ণ-বিবর্ণ ছাত্র। তার কথার আগামাথা কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। স্বরও অস্পষ্ট। সব শ্রোতাই অমনোযোগী হয়ে বসে আছে। স্টেজের প্রধান চেয়ারে বসে মুগ্ধ নয়নে কান পেতে সেই বক্তৃতা শুনছেন প্রিন্সিপাল। যেন চোখ দিয়ে তাকে উৎসাহ দিচ্ছেন। 

[অনুপ্রেরণা দাতা]

শহরের বিভিন্ন কলেজের একদল শিক্ষার্থী ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গার্ডেনে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। অলৌকিকভাবে সেটা প্রিন্সিপালের কানে পৌঁছায়। প্রিন্সিপাল তাঁর সহযোগীদের নিয়ে সেই জায়গায় যান; এবং সকল শিক্ষার্থীকে তাদের নিজ-নিজ ক্লাসে পাঠিয়ে দেন। 

[দায়িত্ববোধ]

তাঁর নেতৃত্বে কলেজ একাধিকবার দেশের শীর্ষ কলেজের মর্যাদা পাওয়ার পরেও তিঁনি কখনও আত্মতুষ্টিতে ভুগতেন না।

[নিরহংকারতা]

আর একদিন পরেই রাজশাহী কলেজের এই নায়ক কলেজ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নিবেন। মানুষটার বিন্দুমাত্র অহংবোধ নেই; কিন্তু এক গভীর মমত্ববোধ আছে কলেজের প্রতিটা জীব ও জড়’র প্রতি। কলেজের প্রতিটা ভবন, খেলার মাঠ, নিজ হাতে রোপণ করা বৃক্ষরাজি, পুকুর, রাস্তা, এমনকি ধূলিকণারাও হয়তো নিঃশব্দে কাঁদবে তাঁর বিদায়ের দিন। আর তিঁনি….! তিঁনি লোকচক্ষুর সামনে না হলেও, হয়তো কোনো এক গভীর রাতে কলেজের কথা মনে করে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদবেন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here